এখনও বন্যার ক্ষতচিহ্ন সড়কে সড়কে

সিলেটের বিশ্বনাথে ২০২২ সালের জুনে ভয়াবহ বন্যায় সবক’টি গ্রামীণ সড়কসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এলজিইডির প্রায় দেড় শতাধিক সড়ক। এতে প্রায় ৭০ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩৫টি সড়ক।
আর প্রায় ৯৫ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এলজিইডির আওতাধীন বিশ্বনাথের ‘কাদিপুর-লামারচক-বৈরাগীবাজার’ এবং নকিখালী-সিংগেরকাছ’ সড়কসহ প্রায় ১২৫ট সড়ক।
অপরদিকে ৯০ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সওজ সিলেটের আওতাধীন ‘রশিদপুর-বিশ্বনাথ-রামপাশা-লামাকাজী’ ১৫ কিলোমিটার সড়ক।
বন্যাপরবর্তি সময়ে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণসড়ক মিলিয়ে ১০৫টি সড়ক চিহিৃত করেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বিশ্বনাথের (এলজিইডি) কর্মকর্তারা।
তারপর ওই সড়কগুলি দ্রুত সংস্কারের জন্য তালিকা তৈরি করে প্রায় ৩৫কোটি টাকার একটি প্রস্তবনা (সড়ক-মেরামত) বাজেট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠান তারা।
কিন্তু ষ্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার প্রায় ১৪মাস পেরিয়ে গেলেও উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত জনগুরুত্বপুর্ন ওই ১০৫টি সড়ক সংস্কারে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বন্যা পরবর্তি সময় থেকেই সড়কগুলির ভয়াবহ ক্ষতচিহ্নের উপর দিয়েই প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে চলছে হাজার হাজার যানবাহন। খানাখন্দে ভরপুর আর ছোটবড় গর্তগুলো দেখলে মনে হয় যেন, ছোট-বড় পুকুর। এমন অবস্থায় ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের। আর মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন সওজের আওতাধীন ‘রশিদপুর-বিশ্বনাথ-রামাপাশা-লামাকাজী’ সড়ক দিয়েই কাদিপুরস্থ উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সেও যেতে হচ্ছে চিকিৎসকসহ এই অঞ্চলের হাজার হাজার জনসাধারণ ও অসুস্থ রোগীদের। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পুরো উপজেলাবাসীকে।
দুর্ভোগ লাঘবে পৌরসভার পক্ষ থেকে ‘বিশ্বনাথ-লামাকাজী’ সড়কের দশদল পর্যন্ত ইটের খোয়া ফেলা হয়। কিন্তু তারপরও বেহাল ওই সড়ক।
অথচ, চলতি ২০২৩ সালের গত ১৩জুন বেহাল ‘রশিদপুর-বিশ^নাথ-রামপাশা-লামাকাজী’ সড়ক মেরনামতের জন্য কার্যাদেশ পায় ৮৩৫৪৩৯ নং আইডিধারী ‘আবিদ-মনসুর কনষ্ট্রাকশন’ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, নামমাত্র ইটের খোয়া ফেলে বরাদ্দের ২১লাখ ২৮হাজার ৩৯৬টাকা ভাগভাটোয়ারা করে নেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সওজ’ কর্মকর্তারা।
তবে, সংস্কার নিয়ে নানা বিতর্ক আর অভিযোগ থাকলেও সম্প্রতি আবারও প্রায় ৯কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই সড়ক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বেহাল অবস্থায় রয়েছে ‘নকিখালী-সিংগেরকাছ’ আরএইচডি সড়কের পৌনে ১০কিলোমিটার, ‘রামপাশা-বৈরাগী বাজার’ আরএইচডি সড়কের ২কিলো ১০০মিটার, ‘বিশ^নাথ-টেংরা-লালা বাজার’ আরএইচডি সড়কের সাড়ে ৪কিলোমিটার, বিশ্বনাথ-নতুনবাজার-কুরুয়া’ আরএইচডি সড়কের সোয়া ৬কিলোমিটার, ‘বিশ্বনাথ কলেজ-নাজিরবাজার’ আরএইচডি সড়কের পৌনে ৪কিলোমিটারসহ প্রায় সবকটি সড়ক। তার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা ‘কাদিপুর-লামারচক-বৈরাগীবাজার’ সড়কের।
গেল বন্যাকালীণ সময়ে লামারচকের ইশকার আলীর বাড়ির সামনের মোড়ের কালভার্টসহ প্রায় ২০০থেকে ৩০০মিটারেরও বেশি পাকা সড়ক উপড়ে বানের পানিতে ভেসে গিয়ে বড় একটি খালে পরিনত হয়।
২০২২সালের ডিসেম্বরে সিএনজি চালক ও স্থানীয়রা মিলে মাটি দিয়ে ভরাট করে দিলে কিছুদিন যানবাহন চলাচল করে। এরপর ২০২৩ সালের মে মাস থেকে প্রায় ৬মাস ধরে ওই সড়ক দিয়ে যান চলাচলব বন্ধ রয়েছে।
বর্তমানে ওই মোড়ের খালে বাঁশ দিয়ে পারাপারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে স্থানীয় লোকজনকে মাছ শিকার করতেও দেখা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পেশায় বাস চালক শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন কমপক্ষে ৪বার ‘বিশ্বনাথ-রৈরাগী-সিংগেরকাছ’ সড়ক দিয়ে যাত্রী নিয়ে যান তিনি। এতে বিভিন্ন সময় ব্রেক ফেল হয় এবং গাড়ির ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বিকল হয়।
সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক সিরাজ উদ্দিন, মখন মিয়া, ইনসান আলীরও একই দাবি।
আর লামারচকের ইজিবাইক চালক হারিছ আলী বলেন, সারাদিনে ৩০০ টাকা ইনকাম হলেও রাস্তা ভাঙার কারণে গাড়িতে কাজ আসে ৩৫০টাকা। এতে লাভের জায়গায় আরও লোকসান গুনতে হয় তাকে।
রামপাশা এলাকার ফারুক আহমদ, নজরুল ইসলাম, লামাকাজি এলাকার শাহনুর হোসাইন, আবিদ আলী ও সমুজ আলী বলেন, বন্যার পর সংস্কার না হওয়ায় সড়কদিয়ে চলাচল করাই দায়। একবার যাতায়াত করলে পরদিন শরীরের ব্যাথায় আর বের হওয়ার ইচ্ছে থাকেনা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, দীর্ঘদিন সংস্কার কাজ না হওয়ায় সড়কজুড়ে গর্ত আর খানাখন্দ। জনসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবে পৌরসভার পক্ষ থেকে বিশ্বনাথ পৌরশহর থেকে কাদিপুর পর্যন্ত ইট ফেলে গর্ত ভরাট করে তিনি দিয়েছেন।
কিন্তু সওজ কর্তৃপক্ষ কবে কোথায়? সড়ক মেরামত করালেন, তা চোখে পড়েনি। সংস্কারের নামে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিশ্বনাথ উপজেলা প্রকৌশলী মো. আবু সাঈদ এ প্রতিবেদককে বলেন, বন্যার পর এলজিইডির আওতাধীন প্রায় ১০৫টি সড়ক চিহ্নিত করে দ্রুত সংস্কারের জন্য ৩৫ কোটি টাকার একটি প্রস্তাবনা বাজেটসহ সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তিতে অগ্রগতির আর কোন সংবাদ তিনি পাননি।
‘আবিদ-মনসুর কনষ্ট্রাকশন’র কর্নধার আবিদ মনসুরকে ফোনে কল করা হলেও গত ১৫দিনে তিনি ফোনকল রিসিভ না করায় তার কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে, সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, ইটের খোয়া ফেলার বিষয়টি ছিলো ভিন্ন একটি ইস্যু।
বর্তমানে ৯ কোটি ৫৭লাখ টাকা ব্যয়ে ‘রশিদপুর-বিশ্বনাথ-রামপাশা-লামাকাজী’ সড়ক সংস্কার কাজ শুরু করা হচ্ছে। ত্রিপুরা কনস্ট্রাকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে এবং আগামি ৬মাসের মধ্যে তা সম্পন্ন করা হবে।
ডেসিস/জেকে/ ২৩ অক্টোবর ২০২৩ইং